
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার যদি নিরপেক্ষতা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তবে তারা নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতা হারাবে। মঙ্গলবার বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
জুলাই মাসের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এ প্রেক্ষাপটে, যদি তারা সরকারে নিজেদের প্রতিনিধি রেখে নির্বাচনে অংশ নিতে চায়, তবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো এই বিষয়টি মেনে নেবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব।
সাক্ষাৎকারে আগামী নির্বাচনের পরিকল্পনা, আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ, সংস্কার প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
দুই পর্বে বিএনপির মহাসচিবের সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন বিবিসি বাংলার সম্পাদক মীর সাব।
বিবিসি বাংলা: মি. আলমগীর, বিবিসি বাংলার সাক্ষাৎকারে অংশগ্রহণের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি কেমন আছেন?
মির্জা ফখরুল: আমি ভালো আছি, ধন্যবাদ। সবকিছু ভালো চলছে।
বিবিসি বাংলা: প্রথমে নির্বাচনের প্রসঙ্গে আসতে চাই। সম্প্রতি আপনি একটি সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেছেন যে ২০২৫ সালের জুলাই-অগাস্টের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব। এটি কি একটি সম্ভাবনা, নাকি আপনারা সত্যিই চান যে জুলাই-অগাস্টে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক?
মির্জা ফখরুল: আমরা আগেই বলেছি, আমরা আগাম নির্বাচনের পক্ষে। আমরা মনে করি, ন্যূনতম সংস্কারগুলো যথাযথ সময়ে সম্পন্ন করে যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা উচিত। আমাদের পূর্ববর্তী কেয়ারটেকার সরকারের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, এটি অসম্ভব কিছু নয়। যদি সরকার চায়, তাহলে জুন-জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব।
বিবিসি বাংলা: তবে কি আপনাদের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই?
মির্জা ফখরুল: আমরা এখনও কোনো সময়সীমা নির্ধারণ করিনি।
বিবিসি বাংলা: যদি আপনারা লক্ষ্য করেন, নির্বাচনের সময়সীমা যা আপনারা প্রত্যাশা করছেন, তা পূরণ হচ্ছে না। এ অবস্থায় আপনারা কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন?
মির্জা ফখরুল: এ বিষয়ে আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব। আমাদের দলের মধ্যে আলোচনা হবে এবং যাঁরা আন্দোলনে আমাদের সঙ্গে ছিলেন, তাঁদের সঙ্গেও আলোচনা করা হবে। আলোচনা শেষে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাবো।
বিবিসি বাংলা: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন যে তাঁরা কিছু সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে চান এবং সেগুলো শেষ হলে নির্বাচনে যাবেন। তাহলে, আপনারা কি সংস্কার কার্যক্রম শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে প্রস্তুত?
মির্জা ফখরুল: আমরা আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করে জানিয়ে এসেছি। বলেছি যে তিনি যে সংস্কারগুলো হাতে নিয়েছেন, সেগুলো সম্পন্ন করতে ১০ বছরও লাগতে পারে। আর সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া।
বিবিসি বাংলা: আপনি কি মনে করেন যে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয় বা তারা তা করতে পারবে না?
মির্জা ফখরুল: আমরা বলছি না যে এটি করা উচিত নয়। তবে, সব দলের সম্মতি না থাকলে তাদের জন্য এটি করা সঠিক হবে না।
বিবিসি বাংলা: এই সরকারের মেয়াদ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে এবং নির্বাচন পর্যন্ত এই সরকারের মেয়াদ থাকবে—এটাই সকলের ধারণা।
মির্জা ফখরুল: যদি সরকার সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রাখে, তবে তারা নির্বাচন পরিচালনা করা পর্যন্ত থাকবে। অন্যথায়, নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে।
বিবিসি বাংলা: আপনি কি মনে করেন, এই সরকারের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে?
মির্জা ফখরুল: নিরপেক্ষতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমরা লক্ষ্য করছি যে ছাত্ররা একটি রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা করছে। যদি ছাত্রদের প্রতিনিধি এই সরকারের অংশ হন, তাহলে তারা নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। এটি একটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি। তবে যদি তারা মনে করে যে (সরকারে) থেকেই নির্বাচন করবে, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো তা মেনে নেবে না।
বিবিসি বাংলা: আপনার কি ধারণা, সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে বর্তমানে কোনো প্রশ্ন উঠেছে?
মির্জা ফখরুল: বর্তমানে কোনো প্রশ্ন নেই। আমাদের কাছে কোনো প্রশ্ন নেই।
বিবিসি বাংলা: ৫ অগাস্টের পর যখন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আলোচনা চলছিল, তখন আপনারাও সেই আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তীতে সরকার গঠন করা হয়। এই অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকাল সম্পর্কে আপনারা কি ভাবছেন?
বিবিসি বাংলা: অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আপনি নিজেই বলেছিলেন যে আপনারা এই সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা করবেন।
মির্জা ফখরুল: আমরা সহযোগিতা করছি।
বিবিসি বাংলা: এটি এখনও চলমান আছে?
মির্জা ফখরুল: এটি এখনও চলমান। তারা যখনই আমাদের ডাকেন, আমরা সেখানে যাই এবং আলোচনা করি। ডাক না দিলে তো যাওয়া সম্ভব নয়, তবে আমরা আগ্রহী হয়ে কথা বলি। আমরা যেসব বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, সেগুলো তাদের জানাই। আমরা সহযোগিতামূলক। এখন পর্যন্ত সরকারের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন করিনি এবং কোথাও সমালোচনা করিনি। তবে কিছু ভুলত্রুটি তুলে ধরতে হয়।
বিবিসি বাংলা: শুরু থেকে আপনারা যে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছেন, তা এখনও একই রকম আছে? নাকি এখানে কোনো দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে?
মির্জা ফখরুল: আমাদের মনে হয় যে সম্পর্কটি অপরিবর্তিত রয়েছে।
বিবিসি বাংলা: সরকারের বিভিন্ন স্তর থেকে প্রায়ই একটি বিষয় বলা হয় যে তারা যে সংস্কারগুলো…
বিবিসি বাংলা: ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়।
মির্জা ফখরুল: এ বিষয়ে কোনো প্রশ্নই নেই। আমাদের দলটি তো এমন নয়। আমরা একটি গণতান্ত্রিক দল। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। আমরা সবসময় গণতন্ত্রের চর্চা করার চেষ্টা করেছি। আমরা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছি। ১৫ বছর ধরে আমরা এই গণতন্ত্রের জন্য, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করেছি। খালেদা জিয়া প্রায় ছয় বছর কারাগারে ছিলেন এই মামলার কারণে, এই গণতন্ত্রের জন্য এবং আমাদের তারেক রহমান সাহেব এখনও বিদেশে অবস্থান করছেন। আমাদের বিরুদ্ধে প্রায় ৬০ লাখ মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। আমাদের প্রায় সাতশ মানুষ গুম হয়ে গেছে। আমাদের হাজার হাজার লোক গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ হারিয়েছে। এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে গণতন্ত্রের জন্য। তাই আমাদের দলে এ ধরনের প্রশ্ন উঠতেই পারে না। আপনি আমাদেরকে গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন বলতে পারেন।
বিবিসি বাংলা: প্রস্তাবে দ্ব chambers এর উল্লেখ করা হয়েছে—নিম্নকক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হবে এবং উচ্চকক্ষ হবে আনুপাতিক ভোটের ভিত্তিতে। আপনারা কি এ বিষয়ে একমত?
মির্জা ফখরুল: না, আমরা এ বিষয়ে একমত নই। আমাদের ভিন্ন প্রস্তাব রয়েছে, যা আমরা আলোচনা করে তুলে ধরব।
বিবিসি বাংলা: আমরা লক্ষ্য করেছি যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিভিন্ন সময়ে তাদের কিছু দাবি উত্থাপন করেছে, যেগুলোর বিরুদ্ধে আপনারা অবস্থান নিয়েছেন বা বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবি, জুলাই মাসের অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র এবং সম্প্রতি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি এসেছে, যা আপনারা বিরোধিতা করেছেন। এসব বিষয়ে আপনারা কেন আপত্তি করছেন?
মির্জা ফখরুল: (হাসি) আপত্তির কারণ যথার্থ। আমরা তো একটি সংবিধানের আওতায় আছি। রাষ্ট্রের যে সংবিধান, সেটির অধীনে।
বিবিসি বাংলা: কারা?
মির্জা ফখরুল: কিছু লোক হয়তো আছে। তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে। আমি সঠিকভাবে বলতে পারব না, তবে আমার ধারণা, একাত্তরকে পিছনে ফেলার একটি চিন্তা কিছু মানুষের মধ্যে থাকতে পারে।
বিবিসি বাংলা: একাত্তরকে পিছনে ফেললে কী লাভ হবে?
মির্জা ফখরুল: যাদের লাভ হবে, সেটা আপনারা সবাই জানেন। আমি পুনরাবৃত্তি করতে চাই না।
বিবিসি বাংলা: জুলাই অভ্যুত্থান সম্পর্কে বলি। নির্বাচনের প্রসঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে নির্বাচনের জন্য জুলাই অভ্যুত্থান হয়নি। আপনাদের নির্বাচনের দাবির বিপরীতে জুলাই অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। এই বিষয়টি আপনারা কিভাবে দেখছেন?
মির্জা ফখরুল: আমাদের খুব স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ভাই। আমরা আন্দোলন করছি, রাজনৈতিক দল গঠন করছি দেশের একটি গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য।
বিবিসি বাংলা: কোথায় ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে?
মির্জা ফখরুল: আমরা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছি যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে জনগণের সিদ্ধান্ত। যদি জনগণ চায় যে তারা কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করবে, তবে তারা তা করতে পারে। এটি কিভাবে হবে? এটি পার্লামেন্টে অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে হতে পারে।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু আপনি কিভাবে জানবেন জনগণের ইচ্ছা কী?
মির্জা ফখরুল: ভোটের মাধ্যমে এটি জানা সম্ভব। নির্বাচনের মাধ্যমেই এটি বোঝা যাবে। আমি একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি। আমি অন্য একটি রাজনৈতিক দলকে নীতিগতভাবে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নই। জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার সময় আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। আমরা নীতিগতভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলোর নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে। আমরা বলেছি যে জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে।